ভোজ্যতেলের নানাবিধ ব্যবহারে তিল তেল
এবং তিল ফসলের সম্ভাবনা
ড. আব্দুল মালেক
তিল তেল উচ্চপুষ্টিসমৃদ্ধ ভোজ্যতেল। তিলতেলে বেশ কিছু ভিটামিন যেমন- ভিটামিন-ই, বি কমপ্লেক্স ও ডি এবং খনিজ উপাদান কপার, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে। ফলে এ তেলে রান্না করা খাবার খেলে হাড়ের ক্ষয়রোধের পাশাপাশি অস্টিওপোরোসিস রোধসহ হাড়ের জোড়ায় ব্যথাজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণেও কাজ করে। কাজেই প্রতিদিনের রান্নায় তিল তেলকে সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষণার তথ্য মতে, তিলতেল রক্তচাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তিলতেলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-ই এবং এন্টিঅক্সিডেন্টসমূহ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদযন্ত্রকে ভাল রাখতে সহায়তা করে। তিলবীজে ৪২-৪৫% তেল এবং ২০-২৮% আমিষ থাকে। তিলতেলে মানব শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ৮০-৮২% এর বেশি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড আছে যা কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে শক্তিশালী রাখতে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া তিল তেলে ‘টাইরোসিন’ নামের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। যা মানসিক অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে। তিল তেল প্রয়োজনীয় এনজাইম ও হরমোন সরবরাহ করার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে মন-মেজাজও ভালো রাখে।
নানাবিধ পুষ্টিগত গুণাগুণের কারণে আদিকাল থেকেই ভোজ্যতেল হিসেবে তিল তেল ব্যবহার হয়ে আসছে। রান্নার কাজে ব্যবহার ছাড়াও শরীর ও মাথায় ব্যবহারেও তিল তেলের আলাদা কদর রয়েছে। তিল তেল চুল পড়া কমায়, চুল পাকা রোধ করে, প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন হিসেবে কাজ করে এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতাও বাড়ায়। তিল তেলে এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকায় এটি স্কিনের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া তিল তেল একটি অসাধারণ ময়েশ্চারাইজার এবং এতে ডিটক্সিফাইং উপাদান থাকায় শুষ্ক ও মৃত কোষ দূর করার মাধ্যমে ত্বককে নরম ও কোমল রাখে এবং এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে বলে অ্যান্টি-এজিং হিসেবে কাজ করে ও ত্বকের কুচকিয়ে যাওয়া প্রতিহত করতে সাহায্য করে।
ভোজ্যতেলের প্রয়োজনীয়তা : মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্যাট বা চর্বি অর্থাৎ তেল। এই ফ্যাট দেহের তাপশক্তি উৎপাদন, মস্তিষ্কের বিকাশ, বিভিন্ন হরমোনের উৎপাদন, চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন (এ. ডি. ই. কে) শোষণ এবং ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। মূলত ফ্যাট দেহের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো দেহের কোষের বিকাশ, কোলেস্টেরলের মাত্রা স্থিতিশীল রাখা এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অ্যাভোকাডো, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল (ক্যানোলা/সরিষা, জলপাই, চীনাবাদাম, তিল তেল) মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের ভালো উৎস। অন্য দিকে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রধানত উদ্ভিজ্জ তেল (সূর্যমুখী, তিল, সয়াবিন, কর্নওয়েল) ও সামুদ্রিক মাছে পাওয়া যায়। এ ফ্যাট খাওয়ার ফলে এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। অপর দিকে খারাপ ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাট জাতীয় খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর, খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএলের পরিমাণ বাড়ায় এবং ভাল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। চর্বিযুক্ত মাংস, ক্রিম, বাটার, চিজ, পাম অয়েল, নারকেল তেল, ফ্রাই করা খাদ্যে এ ফ্যাট বেশি পাওয়া যায়। তাই ফ্যাটজাতীয় খাবারকে একেবারে বাদ না দিয়ে, ভাল ফ্যাট গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং খারাপ ফ্যাট বর্জনের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ভাল তেল রক্তের এইচডিএল অর্থাৎ শরীরের জন্য উপকারী ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। মানবদেহে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল বেশি থাকলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে উদ্ভিজ্জ তেল। উদ্ভিজ্জ তেল হৃদরোগ ও রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয় আর লিভারকে সচল রাখে। তাই পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি ও উৎপাদন পরিস্থিতি : দেশে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী হতে প্রাপ্ত ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ৩ লাখ মে. টনের মতো, কিন্তু আমাদের দেশীয় চাহিদা মোট ২৪ লাখ মে. টন। অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই এখনো আমদানি নির্ভর। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসেবে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পাম তেল এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়েছে এবং এতে ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এমতাবস্থায় ভোজ্যতেলের উৎপাদনের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা মেটাতে সরিষার পাশাপাশি তিলের আবাদ এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি করতে হবে।
দানাদার ফসল, ফল ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পারলেও ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ বিগত বছরগুলোতে ছিল চাহিদার তুলনায় মাত্র ১২ শতাংশ, যা সাম্প্রতিককালে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এখনই সময় তিলসহ অন্যান্য ভোজ্যতেলের উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার।
দেশে তিল উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা : বাংলাদেশে তেলবীজ ফসলের মধ্যে তিলের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০২১-২০২২) অনুসারে দেশে গড়ে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে তিল চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৩১ হাজার মেট্রিক টন। খরিফ-১ এবং রবি উভয় মৌসুমেই তিলের চাষ হলেও বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ তিলের আবাদ হয় খরিফ-১ মৌসুমে। খরিফ-১ মৌসুমের জন্য পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, রাঙ্গামাটি এবং এই জেলাগুলোর নিকটবর্তী অঞ্চল তিল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০২১-’২২) অনুযায়ী ২০১৯-’২০ থেকে ২০২১-’২২ পর্যন্ত তিলের জাতীয় গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৯৪৪ কেজি, যা ২০০১-২০১৭ পর্যন্ত ছিল মাত্র ৮৪০ কেজি। স্বাভাবিক ফলনের তুলনায় তিলের জাতীয় গড় ফলন কম হওয়ার মূল কারণগুলো হলো অনাকাক্সিক্ষত ঝড় এবং ফুল আসা পর্যায়ে শুরুতে/শেষে অথবা ফলধারণ পর্যায়ে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন, উপযুক্ত পরিচর্যা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ না হওয়া। আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনায় সঠিক সময়ে সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, উন্নত জাতের ব্যবহার, উপযুক্ত পরিচর্যাসহ আধুনিক চাষাবাদ কৌশল অবলম্বনে তিলের ফলন হেক্টরপ্রতি ১২০০-১৫০০ কেজিতে উন্নীত করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনাসমূহকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সমম্বিত উদ্যোগ। বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করে তেলজাতীয় ফসলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা অনেকাংশেই সম্ভব। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা যেমন- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রামে; চর এলাকা যেমন- নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে বাদাম, তিল, সূর্যমুখী ও সরিষা এবং পার্বত্য এলাকা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সরিষা ও তিল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল তিলের জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে তিলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ঠ সুযোগ আছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় সময়োপযোগী কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে কৃষিতে এক দুর্বার গতি সঞ্চারিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী দুই বছরে (জুন ২০২৫ পর্যন্ত) দেশের ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমপক্ষে ৪০% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা) বিনা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল : ০১৭১২১০৬৬২০, ই-মেইল : সধষবশনরহধ@মসধরষ.পড়স